আমাদের সমাজে নরমাল ডেলিভারী এবং সিজারিয়ান ডেলিভারী নিয়ে নানাধরনের মতভেদ এবং কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত থাকায় অভিভাবকগ্ণ অনেক সময় দ্বিধাগ্রস্থ থাকেন। কোন ধরণের ডেলিভারী আপনার জন্য ভাল হতে পারে তা বেছে নেওয়ার জন্য ২ টি চিকিৎসা পদ্ধতির সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে আপনি যদি সচেতন থাকেন তবে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আপনার অনেকটা সুবিধা হবে।
নরমাল এবং সিজারিয়ান ডেলিভারি দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণত গর্ভবতীর অনেক গুলো শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। মায়ার ডাক্তারদের মতে-
নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি
মা ও বাচ্চা উভয়ের শারিরীক অবস্থা অনুকূল থাকলে নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি -র ই প্রাধান্য বেশি থাকে তবে তা নির্ভর করবে আল্ট্রাসাউন্ড ও ডেলিভারি সময় শারীরিক পরিস্থিতির উপর ।
সুবিধাসমুহ
- নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি এর সুবিধাসমূহগুলো হচ্ছে –
- হাসপাতাল অল্পসময় ( ২৪-৪৮ ঘন্টা ) থাকতে হয়। মা শিগ্রই সুস্থ হয়ে উঠে এতে করে শিশু ও নিজের যত্ন নিতে সুবিধা হয়।
- বাচ্চার সাথে মায়ের মানসিক বন্ধন তুলনামুলকভাবে দ্রুত প্রগাঢ় হয়। যেহেতু, অতি দ্রুত মা ,শিশু কে বুকের দুধ দিতে সক্ষম হন।
- সার্বিকভাবে শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই প্রসেসে বাচ্চা মায়ের গর্ভ থেকে বাহিরে আসে তাই এতে সাধারণত বাচ্চার কোনো ইনজুরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।
- রক্তপাতের পরিমান কম হয়ে থাকে , ইনফেকশন , এনেস্থেটিক রিঅ্যাকশন এর ঝুঁকি থাকে না।
- সেলাইয়ের ঝুঁকি পোহাতে হচ্ছে না।
- কম খরচেই এটি করা সম্ভব।
- ৪৫দিন পর থেকেই মায়ের যোনি অনুকূল থাকলে ও সম্মতি থাকলে সতর্কতা অবলম্বন করে সহবাস ( কনডম ব্যবহার ) মিলন সম্ভব।
ঝুঁকিসমূহ
নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি ক্ষেত্রে যেসব ঝুঁকি থাকে তা হলো –
- যদি ডেলিভারিতে দীর্ঘক্ষণ সময় লাগে ও মায়ের যোনির খুব বেশি প্রসারণ ঘটে কিংবা ফেটে যায় সেক্ষেত্রে কখনও কখনও এপিসিওটমি বা Perineal Stitch দেওয়া লাগতে পারে।
- এই প্রসারণ দীর্ঘক্ষণ হলে অনেকের কিছু দিন পর্যন্ত প্রস্রাব ও পায়খানার সমস্যা বা ব্যাথা হতে পারে তবে তা নির্মূল যোগ্য।
- পেলভিক পেশীগুলির সম্ভাব্য দুর্বলতা।
সিজারিয়ান ডেলিভারী
সিজারিয়ান ডেলিভারি হ’ল শল্যচিকিৎসার মধ্যমে পেটের প্রাচীরের মধ্যে একটি ট্রান্সভার্স (অনুভূমিক) বা উল্লম্ব ছেদ তৈরি করা হয় জরায়ু প্রাচীর পর্যন্ত এবং তারপরে শিশুটিকে জরায়ু প্রাচীরের মাধ্যমে বের করা হয়, গর্ভের নাড়িটি কাটা হয় এবং প্লাসেন্টা সরানো হয়, এর পরে জরায়ু এবং পেটের প্রাচীরটি সেলাই দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সিজারিয়ান দুই রকমের হয়ে থাকে একটি হচ্ছে ইমার্জেন্সি ও অপরটি হচ্ছে ইলেক্টিভ অর্থাৎ যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় আগে থেকেই সিজার করাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।ইমার্জেন্সি সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে মা ও বাচ্চার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ডাক্তার এই পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
কারণসমুহ
- একাধিক বাচ্চা জন্মদানে যেমন যমজ বা ট্রিপলেট।
- লেবারের ব্যাথা দীর্ঘসময় অনুভব করতে ব্যর্থ হলে বা জরায়ুমুখ না খুললে।
- মায়ের এমন কোন সমস্যা থাকলে যখন নরমাল ডেলিভারীকে অনিরাপদ বলে মনে করা হয়।
- যোনিপথে প্রসবের জন্য শিশুটি অনেক বড় হলে।
- পূর্বের সিজারিয়ান পদ্ধতিতে জন্ম দিয়ে থাকলে।
- বাচ্চা ব্রিচ বা ট্রান্সভার্স অবস্থানে থাকলে।
- প্লাসেন্টার জটিলতা।যেমন গর্ভফুল দিয়ে জরায়ু মুখ সম্পুর্ন ঢেকে থাকলে।
- নাভির জটিলতা।
- মায়ের কোন যৌন রোগ বা এসটিডি থাকলে যা নরমাল ডেলিভারীতে শিশুর জন্য হুমকি তৈরি করে।
- মা ইচ্ছাকৃত ভাবে সিজারিয়ান ডেলিভারী নির্বাচন করলে।
- মায়ের কোমর ও বাচ্চার মাথার আকারের বড় ধরনের অসামঞ্জস্য।
- মায়ের একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি,হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগ থাকলে।
সুবিধাসমুহ
- জন্মদানের প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক কম দীর্ঘায়িত হয়।
- ভ্রূণের কোন জটিলতার জন্য নরমাল ডেলিভারী অনিরাপদ হলে।
- বাচ্চা জন্মদানের জন্য পরিপক্ক হলে ইচ্ছেমত সময়ে ডেলিভারী করা যায়।
- প্রসব বেদনা সহ্য করতে হয় না।
ঝুঁকিসমূহ
- হাসপাতালে বেশিদিন থাকতে (৩-৫ দিন)হয়।
- নরমাল ডেলিভারির তুলনায় জটিলতার ঝুঁকি বেশি।
- সেলাইয়ের ইনফেকশন, এনেস্থেটিক রিঅ্যাকশন এর ঝুঁকি বেশি থাকে।
- অধিক রক্ত পাত বা রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
- পরিপূর্ণ সুস্থ হতে সময় বেশি (কোন কোন ক্ষেত্রে প্রায় দুই মাস ও) লাগে।
- পেটের পেশীর দুর্বলতা ।
- অনেক ক্ষেত্রেই বুকের দুধ দিতে বা শিশুর পেতে সময় বেশি লেগে থাকে।ফলে মা ও শিশুর বন্ধন তৈরী হতে কিছুটা বেশি সময় লাগে।
- সহবাস ৬ সপ্তাহ পর থেকে মায়ের যোনি অনুকূল থাকলে ও সম্মতি থাকলে সতর্কতা অবলম্বন করে সহবাস ( কনডম ব্যবহার ) মিলন সম্ভব।
- নরমাল ডেলিভারীর তুলনায় মৃত্যু ঝুঁকি বেশি।
- পরবর্তী প্রসবে সিজারিয়ানের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।
- পরবর্তী প্রেগনেন্সীতে ঝুঁকি বেশি থাকে।
- বাচ্চা প্রসবের পরে নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (NICU) এ ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
- বাচ্চার শ্বাসকষ্ট বা এজমা হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
মায়ার ডাক্তার তাহমিনার মতে- ” সিজার বা নরমাল ডেলিভারীর কোনটি উপযুক্ত তা বাচ্চার এবং মায়ের শারীরিক অবস্থা ,বাচ্চার পেটের ভিতরে পজিশন , প্লাসেন্টার পজিশন এবং মায়ের ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গাইনি ডাক্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। গর্ভবতীর সকল শারীরিক পরীক্ষার ফলাফল অনুকুলে থাকলে নরমাল ডেলিভারী এবং কোন ঝুঁকি বা অসঙ্গতি থাকলে বিকল্প পদ্ধতির শরণাপন্ন হতে পারেন।”
গর্ভকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং যে কোন সমস্যায় মায়ার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করুন। গর্ভকালীন সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ কিনে ঘরে বসে সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগও থাকছে মায়াতে।