দীর্ঘকালীন শারীরিক অসুস্থতা, হোক সেটি নিজের বা প্রিয়জনের, শরীর ও মন উভয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
শরীর আর মন, এই দু’টি একে অপরের সাথে জড়িত। আপনারা হয়তো এই কথাটা প্রায়ই শুনে থাকবেন, মন ভালো তো সব ভালো। ঠিক তাই। অনেকের ক্ষেত্রে এই অসুস্থতা বা মৃত্যু মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।
আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
আমি খুব কাছ থেকে আমার প্রিয়জনকে কঠিন অসুস্থতার সাথে লড়াই করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে দেখেছি। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হয়েছিল মৃত্যুতেই যেন তার শান্তি।
সেই প্রিয়জন আর কেউ নয় আমার সাহসী বাবা, যিনি দীর্ঘ এক বছর যাবত কিডনি জটিলতায় ভুগে এই বছরের খুব সুন্দর এক ভোরে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তার এই কঠিন লড়াইয়ে সাথে ছিলাম আমি আর আমার মা।
তার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া, ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি আর শেষ পর্যন্ত আইসিউতে জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়াইয়ের সবটুকুই আমি দেখেছি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত যে মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম বা এখনো আছি, সেটি যারা ভোগে ঠিক তারাই বুঝতে পারবে। তবে আমি শিখেছি হেরে যাবার নাম জীবন নয়। বরং লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই জীবন।
আমার প্রিয় আদরের বাবাও চায় নি আমি শোকের কাছে হেরে যাই।
প্রতিবছর এই মনস্তাত্ত্বিক ট্রমার কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে বা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কেউ কেউ কোনভাবেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না।
আমাদের উচিত এই শোকের সময়ে অস্থিরতা প্রকাশ না করে নিজেকে যথেষ্ট সময় দেওয়া এবং ধৈর্যধারণ করা।
জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত আসে, সেটি সামলানোর ক্ষমতাও আছে আমাদের মাঝে। এসময়ে যা প্রয়োজন তা হলো মনোসেবা বা কাউন্সেলিং।
যেকোন শোক, ট্রমা, ডিপ্রেশন, বা বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠার জন্য আমাদের উচিত বিশ্বস্ত কারো কাছে সমস্যার কথা খুলে বলা। আর মানসিক স্বাস্থ্য এবং সাহায্যের জন্য মনোচিকিৎসক বা মনোসামাজিক কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হওয়া। যেমনটা আমি করেছি।
দেরি না করে সাহায্য নিয়েছি =অনলাইনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের (সাইকোলজিস্ট)।
আপনি যদি শোক কাটিয়ে ওঠার জন্য পরামর্শ খুঁজতে শুরু করেন, তা হলে হয়তো অসংখ্য সাজেশন খুঁজে পাবেন। যার কিছু হয়তো কাজে লাগবে, কিছু লাগবে না। তবে কিছু মৌলিক ধাপ রয়েছে, যা মেনে চললে এই শোক বা ট্রমা অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
নিজেকে সময় দিনঃ
এই শোকার্ত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন সেটি হলো নিজেকে সময় দেওয়া। যে বিষয়গুলোকে আপনি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেন লাইফে, সেগুলো নিয়ে ভাবা স্টার্ট করুন।
আপনি বাইরে ছুটি কাটানোর কথা চিন্তা করতে পারেন, অথবা আপনার প্রিয় যে বন্ধুটির সাথে অনেক দিন ধরে দেখা হয় না তার সাথে দেখা করার প্ল্যান করতে পারেন।
মোটকথা, ইতিবাচক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন, যেটি আপনার মনের কষ্ট কমাতে সাহায্য করবে।
নিজের ক্ষতি করতে পারে এমন অভ্যাস বা কাজ এড়িয়ে চলুনঃ
শোকগ্রস্ত ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি নিজের ক্ষতি সাধন করতে পারে। এসময় আশেপাশের ক্ষতিকর জিনিসগুলো আমাদের আবেগগত কষ্টকে কাজে লাগিয়ে গুরুতর ক্ষতি নিয়ে আসতে পারে। আর এ উপায়ে যে স্বস্তি আসে তা হয় খুবই সাময়িক সময়ের।
আপনার উচিত এই সময়ে উদ্বিগ্নতা কমিয়ে, নিজের প্রতি নমনীয় হওয়া।
সব মানুষের শোকের অনুভূতির প্রকাশ এক হয় না। নিজেরটা খুঁজে বের করুন। না পারলে কোনো সাইকোলজিস্টের মতামত নিন।
মায়া অ্যাপে আপনি মনের সকল সমস্যার কথা শেয়ার করতে পারেন। কারন এটি নিরাপদ এবং সহজেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে পারেন।
এভাবে অল্প অল্প করে নিজের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
দৈনিক কাজের তালিকা তৈরি করুনঃ
ক্রমাগত শোকের কথা চিন্তা করতে করতে নিজের কাজের তালিকা অনেক ছোট হয়ে যায়। এসময় দরকার হচ্ছে যে কাজগুলো মানসিক চাপ কমাতে বা ভালো বোধ করতে সাহায্য করবে তা করা।
আপনার স্বাভাবিক কাজকর্মের একটি তালিকা তৈরি করুন প্রথমে। আপনি যখন দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য একটি তালিকা মেইনটেন করবেন, তখন আপনা-আপনিই জীবনে একটি স্বাভাবিকতার গতি ফিরে আসবে।
সময়ের সাথে সাথে জীবনে ভারসাম্য চলে আসে। মনের শোক থেকে কিছুক্ষণের জন্য একটু বিরতি নিন, দেখবেন নিজেকে নিয়ে ভাবা বা শোক ভুলে থাকা সহজ হচ্ছে।
কাজের তালিকায় ছোট্ট একটু পরিবর্তন, আপনার মানসিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারবে।
খাদ্যতালিকার প্রতি নজর দিন এবং ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুনঃ
শোকের পরিবেশে আমরা ঠিক মতো খাওয়া বা ঘুমানো একেবারে ভুলে যাই। যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসময় চেষ্টা করবেন বিভিন্ন ধরণের ফল, শাকসবজি ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করবেন, কারণ এসময় শরীর অনেক ডিহাইড্রেটেড হয়ে থাকে।
খাবার খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে, কিছুক্ষণ পর পর অল্প অল্প করে খান। রুচি না থাকলে অনলাইন ডাক্তারের পরামর্শ মতো রুচিবর্ধক ওষুধ খেতে পারেন।
এসময় ব্যায়াম করলে মনের নেতিবাচক আবেগ অনেকাংশে দূর হয়।
স্ট্রেস কমানোর ব্যায়াম করুন, এটি মনের একাগ্রতা বাড়ায়, নেগেটিভ এনার্জি থেকে মুক্তি দেয়।
যখনই অস্থিরতা অনুভব করবেন তখন গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করবেন। অল্প সময় চোখ বন্ধ রেখে উল্টো দিক থেকে কাউন্টিং করলে অনেক মানসিক চাপ কমে।
ব্যায়াম জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার পাশাপাশি প্রিয়জনের মৃত্যু শোক থেকে বিরত থাকার সুযোগ করে দেয়।
গুরুত্ব দিন পারিবারিক সম্পর্কেঃ
ট্রমা বা শোক কমাতে পারিবারিক সম্পর্কে গুরুত্ব দিন। মায়ার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সাইকোলজিস্টরা শোক কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। শোক বা মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পরিবারের মানুষের সঙ্গ অনেক সাহায্য করে।
তবে এমনটি নয় যে আপনাকে ২৪ ঘণ্টা পরিবারের সদস্যদের মাঝেই থাকতে হবে। মাঝে মাঝে একা থাকার ইচ্ছা হতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক । এমনও হতে পারে যারা আপনাকে শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে তাদের উপরই বিরক্ত হয়ে পড়ছেন। এমনটা হলে কিছু সময়ের জন্য ব্রেক নিন, ভাবুন তারা আপনার লাইফে কি ভূমিকা পালন করছে। তাদের কাছে আপনার মনের অবস্থার কথা খুলে বলুন, তাদের জানান বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার কি দরকার আছে আর কি দরকার নেই।
আপনার প্রয়োজন মতো পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটান। এতে মনের চাপ কমবে। মানসিক স্থিতি বাড়বে।
কিছুটা সময় পরিবারের বড়ো সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে বিরতি দিনঃ
পরিবারের সদস্যের মৃত্যুতে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের ভার নিজেকেই নিতে হয়। কিন্তু যেহেতু বর্তমানে আপনি শোকের মধ্যে আছেন। তাই প্রথম কিছুদিন পরিবারের অন্য সদস্যদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিতে পারেন।
যদি সম্ভব হয় কিছুদিন জায়গা পরিবর্তন করে, প্রিয়জনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে রাখতে পারেন, যতদিন না আপনি মানসিক ভাবে শক্ত হতে পারছেন।
এসময় আপনি প্রিয়জনের সাথে কাটানো সুখকর স্মৃতি মনে করিয়ে দিবে এমন জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে পারেন। যখন নিজেকে প্রস্তুত মনে হবে তখনই কেবল সেগুলো দেখুন।
পরিশেষে
আপনিও যদি অসুস্থতা বা প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত শোক বা ট্রমায় ভোগেন তাহলে দেরি না করে এখনি কোনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যান। যদি সরাসরি যোগাযোগে দ্বিধায় ভোগেন তাহলে মোবাইলে মায়া অ্যাপ ডাউনলোড করে ফেলুন। এই অ্যাপের সহায়তায় আপনি যেকোন মুহূর্তে ভিডিও কলের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে পারবেন।
সত্যি বলতে, মনের ক্ষত সাড়তে সময় লাগে। কোনো কিছুই আপনার মনের কষ্ট পুরোপুরি দূর করতে পারবে না। তবে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, উল্লেখিত বিষয়গুলো আপনার শোক পুরোপুরি দূর না করলেও এসব পরামর্শ কাজে লাগানোর ফলে মনের কিছুটা শান্তি মিলবেই। আর মায়া ডিজিটাল হেলথ সার্ভিস তো আছেই মনের যেকোন প্রয়োজনে আপনার পাশে সার্বক্ষাণিক সঙ্গী হিসেবে।